আসলে কুরআন কি?

কুরআন আল্লাহর কালাম বা বাণী। তা আল্লাহর সৃষ্টি জগতের অন্তর্ভুক্ত নয় বরং এটি তার যাত বা স্বত্বার এক অবিচ্ছেদ্য সিফত (বৈশিষ্ট্য)। সিফত বা গুণ-বৈশিষ্ট্য কখনো যাত বা স্বত্বা থেকে আলাদা হয় না। আল্লাহর কোনো গুণ কখনো তার সৃষ্টি হতে পারে না। বরং তার যাত বা স্বত্বা যেমন অনাদি ও অবিনশ্বর তাঁর প্রতিটি সিফাতও (যেমন কথা বলা, দেখা, শোনা, হাত, চোখ ইত্যাদি) অনুরূপ।

কুরআন কি সৃষ্টি?

সুতরাং আল্লাহর কালাম বা কথাকে আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টি জগতের মত একটি সৃষ্টি বস্তু বলার মানে হল, আল্লাহর কথা বলার সিফাতকে অস্বীকার করা।

আবার আল্লাহর কালামকে সৃষ্টি বলা হলে তাতে তার অর্থ হল, আল্লাহর সকল সৃষ্টি যেমন একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে আল্লাহর কালামও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে! নাউযুবিল্লাহ। এটি একটি কুফরি বিশ্বাস-তাতে কোন সন্দেহ নাই।

সালাফদের মত

যাহোক, “কুরআন আল্লাহর কালাম এবং তা আল্লাহর সৃষ্টি নয়।” এ ব্যাপারে সালাফদের মাঝে কোন দ্বিমত ছিল না এবং এখনো হক পন্থীদের মাঝে কোন দ্বিমত নেই আল হামদুলিল্লাহ।

কুরআন সৃষ্টি, এ কথা এলো যেভাবে

ইতিহাস বলে, সর্বপ্রথম কতিপয় বাতিল ফিরকা ও বিদআতি গোষ্ঠী যেমন মুতাযিলা, জাহমিয়া এবং আহলুল কালাম বা যুক্তিবিদরা ‘কুরআন আল্লাহর সৃষ্টি’ বলে বিতর্ক সৃষ্টি করে। এ মতবাদ দ্বারা তারা আল্লাহর সকল সিফাতকে অস্বীকার করতে চায়।

এ মতবাদকে কেন্দ্র করে আব্বাসিয় ও উমাইয়া খেলাফত কালীন সময় মুসলিমদের মাঝে এক চরম ফিতনা-ফ্যাসাদের সৃষ্টি হয়। বিদআতিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আব্বাসী খলীফা মামুন (আব্বাসীয় খেলাফতের ৭ম খলীফা হারুনুর রশিদ এর ছেলে। তার প্রকৃত নাম আব্দুল্লাহ-মৃত্যু ২১৮ হিজরি) এই মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ায় সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে এবং যারা এ মতবাদকে গ্রহণ করতে রাজি হয় নি তাদেরকে অনেক জুলুম-নির্যাতন করে।

বিরোধী মতের সকল কাজী বা বিচারকদেরকে পদচ্যুত করে। আহলুস সুন্নাহর মহান ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. সহ অনেক আলেমের প্রতি নিষ্ঠুর অত্যাচার করে। অবশেষে খলীফা মুতাওয়াক্কিল ক্ষমতায় এসে এই ফেতনার সমাপ্তি ঘটান এবং জেলবন্দিদেরকে বের করে আনেন।

‘কুরআন আল্লাহর সৃষ্টি নয়’- এ ব্যাপারে অভিমত

💠 ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রা. বলেন,

والقرآن كلام الله، ليس بمخلوق، فمن زعم أن القرآن مخلوق فهو جهمي كافر ومن زعم أن القرآن كلام الله عز وجل ووقف ولم يقل مخلوق ولا غير مخلوق: فهو أخبث من الأول،

“কুরআন আল্লাহ কালাম (বাণী); মাখলুক বা সৃষ্ট নয়। যে ব্যক্তি মনে করে যে, কুরআন আল্লাহর মাখলুক (সৃষ্ট) সে জাহমী-কাফির। আর যে ব্যক্তি কুরআন আল্লাহর কালাম বলে চুপ থাকে- মাখলুক না কি মাখলুক নয় সে ব্যাপারে কোন মন্তব্য করে না-সে ১ম ব্যক্তির থেকেও নিকৃষ্ট।

💠 ইমাম ইবনে আব্দুল ইয আল হানাফি (তাহাবীয়া গ্রন্থের ভাষ্যকার), বলেন:

فأهل السنة كلهم من أهل المذاهب الأربعة وغيرهم من السلف والخلف متفقون على أن كلام الله غير مخلوق

“চার মাযহাব সহ পূর্বসূরি ও পরবর্তী মনিষীদের সকলেই একমত যে, আল্লাহর কালাম মাখলুক নয়।

💠 ইমাম ইবনে তাইয়িমা রহঃ এর ব্যাপারে অত্যন্ত দৃঢ়তা সূলভ বক্তব্য আছে। তিনি ‘কুরআন আল্লাহর সৃষ্টি’ মতবাদে বিশ্বাসীদেরকে অত্যন্ত শক্তিশালী ভাবে জবাব দিয়েছেন।

💠শায়খ হাফেয আল হাকামী রহ. বলেন:

কুরআন প্রকৃত অর্থেই আল্লাহর কালাম বা বাণী। অক্ষর-সমূহ এবং তার অর্থ উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। এ নয় যে, আল্লাহর কালাম বলতে শুধু কুরআনের শব্দগুলোকে বুজায়। এমনিভাবে শব্দ ছাড়া শুধু অর্থগুলোর নাম আল্লাহর কালাম নয়। আল্লাহ তা’আলা কুরআনের মাধ্যমে কথা বলেছেন এবং তাঁর নবীর উপর অহি আকারে তা নাযিল করেছেন। মুমিনগণ তা বিশ্বাস করেছে।

সুতরাং আঙ্গুলের মাধ্যমে কুরআন লিখা, জবানের মাধ্যমে তা তেলাওয়াত করা, অন্তরের মাধ্যমে তা মুখস্থ করা, কান দিয়ে শুনা এবং চোখ দিয়ে দেখলেই তা আল্লাহর কালাম থেকে বের হয়ে যায় না। আঙ্গুল, কালি, কলম এবং কাগজ এগুলোর সবই আল্লাহর সৃষ্টি।

কিন্তু এ সব দিয়ে যা লেখা হয়েছে তা সৃষ্টি নয়। ঠিক তেমনি জবান এবং আওয়াজ আল্লাহর সৃষ্টি। কিন্তু জবান দিয়ে তা তেলাওয়াত করা হচ্ছে তা মাখলুক তথা সৃষ্টি নয়। বক্ষসুমহ আল্লাহর সৃষ্টি, কিন্তু তাতে যে কুরআন সংরক্ষিত আছে, তা মাখলুক নয়। কান-সমূহ আল্লাহর সৃষ্টি কিন্তু কান দিয়ে কুরআন আমরা শুনছি, তা মাখলুক নয়।

▪ আল্লাহ তা’আলা বলেন,

“ নিশ্চয় এটা সম্মানিত কুরআন, যা আছে সুরক্ষিত কিতাবে”।

সুরা অওাকিয়াঃ৭৭-৭৮

▪আল্লাহ আরও বলেন,

আপনার প্রতি আপনার পালনকর্তার যে, কিতাব প্রত্যাদিষ্ট করা হয়েছে, তা পাঠ করুন। তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নাই। তাঁকে ব্যতীত আপনি কখনই কোন আশ্রয় স্থল পাবেন না।

সুরা কাহাফ-২৭

তিনি আরও বলেন:

“আর মূষিকদের কেউ যদি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে তাকে আশ্রয় দেবে, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পায়।”

সুরা তাওবাঃ ০৬

কুরআনকে সৃষ্টি মনে করলে কি হবে?

সুতরাং যে ব্যক্তি বলবে যে, কুরআন বা কুরআনের কোন অংশ মাখলুক, তাহলে সে কাফির। তার কুফরি এত বড় যে, তাকে সম্পূর্ণ ইসলাম থেকে বের করে দিবে ।

কেননা কুরআন হচ্ছে আল্লাহর কালাম। তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। আল্লাহর কাছে তা পুনরায় ফেরত যাবে। আল্লাহর কালাম তাঁর সিফাতের অন্তর্ভুক্ত।

সুতরাং যে বলবে আল্লাহর কোন সিফত বা গুণ মাখলুক, সে কাফের ও মুরতাদ। তাকে পুনরায় ইসলামে ফেরত আসতে বলা হবে। ফিরে আসলে তো ভাল, অন্যথায় তাকে কাফের হিসেবে হত্যা করা হবে (অবশ্যই এটি মুসলিম শাসক দ্বারা বিচারের মাধ্যমে হতে হবে)

মুসলিমদের যে সমস্ত হক ও আহকাম রয়েছে তাতে তার কোন অংশ নাই।
(আ’লামুস সুন্নাহ আল-মানসুরা- ৮৩ নং প্রশ্ন)

পড়ুনঃ কুরআনের মধ্যে নবিজীর চুল: একটি মিথ্যা ও শয়তানি গুজব

উত্তর প্রদানেঃ
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।