Tag: ইতিকাফের নিয়ম

  • রমাদানের শেষ দশক, কদরের রাত ও ইতিকাফ

    রমাদানের শেষ দশক, কদরের রাত ও ইতিকাফ

    আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

    সুপ্রিয় ভাই ও বোন,

    দেখতে দেখতে মাহে রামাযান আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। আমরা এসে পৌঁছেছি শেষ দশকে। সৌভাগ্যবান লোকেরা এ মাসে আঁচল ভরে পাথেয় সংগ্রহ করছে আর হতভাগারা এখনো অন্ধকারের অলি-গলিতে উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কল্যাণের বারি বর্ষণ এখনো শেষ হয়ে যায় নি। বন্ধ হয়ে যায় নি তাওবার দরজা বরং আরও বশি সুযোগ নিয়ে মাহে রামাযানের শেষ দশক আমাদের মাঝে সমাগত। আজকের এই পোস্টে দেখব আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য এতে কী উপহার সাজিয়ে রেখেছেন এবং আমরা কীভাবে তা সংগ্রহ করতে পারব।

    প্রিয় পাঠক, আসুন, আমরা আল্লাহ দেয়া উপহারগুলো দুহাত ভরে কুড়িয়ে রামাযানকে আরও অর্থ বহ করে তুলি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।

    রমাদানের শেষ দশক

    ১) রামাযানের শেষ দশকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রী-পরিবার সহ সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন:

    উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন:

    إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ ، وَأَحْيَا لَيْلَهُ ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ

    “রামাযানের শেষ দশক প্রবেশ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমর বেঁধে নিতেন, নিজে সারা রাত জাগতেন এবং পরিবারকেও জাগাতেন।”
    কোমর বাঁধার অর্থ হল: পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে চেষ্টা-সাধনায় লিপ্ত হওয়া। কোন কোন আলেম এর ব্যাখ্যায় বলেন: স্ত্রী সহবাস থেকে দূরে থাকা।

    সহীহ বুখরী, অধ্যায়: শবে কদরের ফযীলত। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ইতিকাফ।

    ২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযানে শেষ দশকে যত বেশি পরিশ্রম করতেন অন্য কখনো করতেন না:

    আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন:

    كَانَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَجْتَهِدُ فِى الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مَا لاَ يَجْتَهِدُ فِى غَيْرِهِ
    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযানের শেষ দশকে (ইবাদত-বন্দেগীতে) যে পরিমাণ পরিশ্রম করতেন অন্য কখনো করতেন না।”

    সহীহ মুসলিম: রামাযানের শেষ দশকে (ইবাদত-বন্দেগীতে) বেশি বেশি পরিশ্রম করা।

    শবে কদর

    ১) শবে কদরে কুরআন অবর্তীণ হয়েছে: আল্লাহ তায়ালা বলেন:

    إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ
    “আমি একে (কুরআন) অবর্তীণ করেছি শবে কদরে।”

    সূরা কাদর: ১

    ২) শবে কদর এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম: আল্লাহ বলেন:

    لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ
    “শবে কদর এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।”

    সূরা কাদর: ৩

    ৩)আল্লাহ তায়ালা শবে কদরকে বরকতময় রাত বলে উল্ল্যেখ করেছেন: আল্লাহ তায়ালা বলেন:

    إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ
    “নিশ্চয় আমি ইহা (কুরআন)কে অবর্তীণ করেছি একটি বরকতময় রাতে।”

    সূরা দুখান: ৩ | আর এ রাত হল শবে কদর।

    ৪) শবে কদরে রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করলে পূর্বের সকল ছোটগুনাহ মোচন হয়ে যায়:

    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

    مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
    “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সোয়াবের আশায় শবে কদরে রাত জাগরণ করে নফল নামায ও ইবাদত বন্দেগী করবে তার পূর্বের সকল (ছোট) গুনাহ মোচন করে দেয়া হবে।”

    সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সোয়াবের আশায় রোযা রাখে।

    শবে কদর কখন হবে?

    শবে কদর হবে রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে:

    ক) আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

    « تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ »
    “তোমরা রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে শবে কদর অনুসন্ধান কর।”

    সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে শবে কদর অনুসন্ধান করা।

    খ) আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

     أُرِيتُ لَيْلَةَ الْقَدْرِ ثُمَّ أَيْقَظَنِى بَعْضُ أَهْلِى فَنُسِّيتُهَا فَالْتَمِسُوهَا فِى الْعَشْرِ الْغَوَابِرِ
    স্বপ্নে আমাকে লাইলাতুল ক্বদ্‌র দেখানো হল। কিন্তু আমার এক স্ত্রী আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়ায় আমি তা ভুলে গিয়েছি। অতএব, তোমরা তা রামাযানের শেষ দশকে অনুসন্ধান কর।” কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে, দু ব্যক্তির বিবাদের কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা ভুলে গেছেন।

    সহীহ বুখারী, অধ্যায়: লাইলাতুল কাদরের ফযীলত।

    গ) শবে কদর কি শুধু রামাযানের সাতাইশ রাতের জন্য নির্দিষ্ট?

    আমাদের দেশে সাধারণত: মানুষ শুধু রামাযানের সাতাইশ তারিখে রাত জেগে ইবাদত বন্দেগী করে এবং ধারণা করে এ রাতেই শবে কদর অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এ ধারণা, সুন্নতের সাথে সঙ্গতীপূর্ণ নয়। কারণ, আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

     تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ
    “তোমরা রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান কর।”

    সহীহ বুখারী, অধ্যায়: লাইলাতুল কাদরের ফযীলত। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: রোযা।

    আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

     أُرِيتُ لَيْلَةَ الْقَدْرِ ثُمَّ أَيْقَظَنِى بَعْضُ أَهْلِى فَنُسِّيتُهَا فَالْتَمِسُوهَا فِى الْعَشْرِ الْغَوَابِرِ »
    স্বপ্নে আমাকে লাইলাতুল ক্বদ্‌র দেখানো হল। কিন্তু আমার এক স্ত্রী আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়ায় আমি তা ভুলে গিয়েছি। অতএব, তোমরা তা রামাযানের শেষ দশকে অনুসন্ধান কর।”

    সহীহ বুখারী, অধ্যায়: লাইলাতুল কাদরের ফযীলত।

    ঘ) তবে শেষ সাত দিনের বেজড় রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি:

    যেমন, নিম্নোক্ত হাদীসটি:

    ابْنِ عُمَرَ – رضى الله عنهما – أَنَّ رِجَالاً مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ – صلى الله عليه وسلم – أُرُوا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى الْمَنَامِ فِى السَّبْعِ الأَوَاخِرِ ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – « أَرَى رُؤْيَاكُمْ قَدْ تَوَاطَأَتْ فِى السَّبْعِ الأَوَاخِرِ ، فَمَنْ كَانَ مُتَحَرِّيَهَا فَلْيَتَحَرَّهَا فِى السَّبْعِ الأَوَاخِرِ »
    ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত যে, কয়েকজন সাহাবী রামা যানের শেষ সাত রাত্রিতে স্বপ্ন মারফত শবে কদর হতে দেখেছেন।  সাহাবীদের এ স্বপ্নের কথা জানতে পেরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আমি দেখছি তোমাদের স্বপ্নগুলো মিলে যাচ্ছে শেষ সাত রাত্রিতে। অত:এব কেউ চাইলে শেষ সাত রাত্রিতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করতে পারে।”

    (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) এ মর্মে আরও হাদীস রয়েছে।

    কোন কোন সালাফে-সালেহীন সাতাইশ রাত শবে কদর হওয়ার অধিক সম্ভাবনাময় বলে উল্লেখ করেছেন। সাহাবীগণের মধ্যে ইবনে আব্বাস (রা:), মুআবিয়া, উবাই ইবনে কা’ব (রা:) এর মতামত থেকে এটাই বুঝা যায়।

    কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এভাবে নির্দিষ্টকরে লাইলাতুল কদর হওয়ার কোন হাদীস নাই। তাই উপরোক্ত সাহবীদের কথার উপর ভিত্তি করে বড় জোর সাতাইশে রাতে শবে কদর হওয়াকে অধিক সম্ভাবনাময় বলা যেতে পারে। নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। সঠিক কথা হল, শবে কদর কখনো ২১, কখনো ২৩, কখনো ২৫, কখনো ২৭ আবার কখনো ২৯ রাতে হতে পারে।

    সুতরাং শুধু সাতাইশ তারিখ নয় বরং কোন ব্যক্তি যদি রামাযানের শেষ দশকের উপরোক্ত পাঁচটি  রাত জাগ্রত হয়ে ইবাদত-বন্দেগী করে তবে নিশ্চিতভাবে শবে কদর পাবে। কিন্তু শুধু সাতাইশ রাত জাগলে শবে কদর পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই। বরং অন্যান্য রাত বাদ দিয়ে শুধু সাতাইশ রাত উদযাপন করা বিদআতের অন্তর্ভূক্ত। বিশেষ করে আমাদের দেশে যেভাবে শুধু সাতাইশ তারিখ নির্দিষ্ট করে নেয়া হয়েছে সেটা বিদআত ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাই বিদআত বর্জন করে সুন্নতী পন্থায় আমল করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।

    ঙ)শবে কদরের বিশেষদুয়া:

    উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি যদি জানতে পারি যে, কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তাহলে তখন কোন দুয়াটি পাঠ করব? তিনি বললেন, তুমি বল:

    اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ كَرِيمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّى
    “হে আল্লাহ, আপনি মহানুভব ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন। অত:এব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।”

    (তিরমিযী, অনুচ্ছেদ, কোন দুয়াটি শ্রেষ্ঠ। তিনি বলেন: হাদীসটি হাসান, সহীহ)।

    ইতিকাফ

    ক) রামাযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত:

    আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত। আল্লাহ তায়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে মৃত্যু দেয়া পর্যন্ত রামাযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তাঁর ওফাতের পর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন।”(সহীহ বুখারী)

    আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রামাযানে দশ দিন ইতিকাফ করতেন। এক বছর সফরে যাওয়ায় ইতিকাফ করতে পারেন নি। তাই যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন সে বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেন । (মুসনাদ আহমাদ, সুনান আবু দাউদ, অধ্যায়: রোযা, তিরমিযী, অধ্যায়: রোযা অনুচ্ছেদ। আল্লামা আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।)

    খ) ইতিকাফ সংক্রান্ত ভুল ধারণা:

    আমাদের দেশে মনে করা হয় যে সমাজের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তিকে অবশ্যই ইতিকাফে বসতে হবে তা না হলে সবাই গুনাহগার হবে। কিন্তু এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। কারণ, ইতিকাফ হল একটি সুন্নত ইবদাত। যে কোন মুসলমান তা পালন করতে পারে। যে ব্যক্তি তা পালন করবে সে অগণিত সোওয়াবের অধিকারী হবে। সবার পক্ষ থেকে একজনকে ইতিকাফে বসতেই হবে এমন কোন কথা শরীয়তে নেই।

    আল্লাহ তাআলা সকল ক্ষেত্রে তার নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নতকে যথাযথভাবে পালন করার তাওফীক দান করুন এবং সকল বিদআত ও সুন্নত বিরোধী কার্যকলাপ থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

    অনুবাদ ও গ্রন্থনা:
    আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলিল
    দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।