কোন পাপ করে ফেললে বা নিজের জীবনের অতিতের পাপের জন্য তওবা-ইস্তিগফার করার পদ্ধতি কি? কোন দুয়া করতে হবে? এবং তওবা-ইস্তিগফার এর শর্তাবলী কি কি?
তওবা-ইস্তিগফার এর অপরিহার্যতাঃ
গুনাহ থেকে তওবা করা ফরয। কোন মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তবে সে ব্যক্তিই উত্তম যে ভুল করার পর তওবা করে। তাই দয়াময় আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের উপর তওবা করা ফরয করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعاً أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে মুমিনগণ,তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তওবা কর। যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পার।”
সূরা নূরঃ ৩১
তিনি আরও বলেছেন,
تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا
“তোমরা আল্লাহর নিকট আন্তরিকভাবে তওবা কর।”
সূরা তাহরীমঃ ৮
সুতরাং প্রতিটি পাপের জন্য বান্দার তওবা করা অপরিহার্য।
তওবাকারীর উপর আল্লাহ আনন্দিত হনঃ
তওবা কারীদের প্রতি আল্লাহ অত্যন্ত আনন্দিত হন। প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খাদেম আবু হামযা আনাস বিন মালিক রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
اللَّهُ أَفْرَحُ بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ مِنْ أَحَدِكُمْ سَقَطَ عَلَى بَعِيرِهِ ، وَقَدْ أَضَلَّهُ فِى أَرْضِ فَلاَةٍ“
কোনও লোক বিজন মরু প্রান্তরে উট হারিয়ে যাবার পর পুনরায় তা ফেরত পেলে যে পরিমাণ আনন্দে উদ্বেলিত হয় মহান আল্লাহ বান্দার তওবাতে তার চেয়েও বেশি আনন্দিত হন।
সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদঃ তওবা, হা/৫৮৩৪, শামেলা
মহান আল্লাহ ক্ষমাশীল; তিনি আমাদেরকে ক্ষমা করতে চান:আল্লাহ তায়ালা দিনের অপরাধীকে ক্ষমা করার জন্য রাতে তাঁর হাত প্রসারিত করেন। আর রাতের অপরাধীকে ক্ষমার জন্য দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করেন।
যেমন, ইমাম মুসলিম রহ. আবু মূসা আশয়ারী থেকে বর্ণনা করেছেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لِيَتُوبَ مُسِىءُ النَّهَارِ وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِىءُ اللَّيْلِ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا
“আল্লাহ দিনের অপরাধীকে ক্ষমার জন্য রাতে তাঁর হাত প্রসারিত করেন। আর রাতের অপরাধীকে ক্ষমার জন্য দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করেন। (তিনি এরূপ করতেই থাকেন) যে পর্যন্ত না সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হয় (তথা কিয়ামত পর্যন্ত)।
সহীহ মুসলিম। অনুচ্ছেদ: গুনাহ থেকে তওবা করলে তা কবুল হওয়া যদিও বারবর গুনাহ সংঘটিত হয়, হা/৪৯৫৪, শামেলা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের অনুসরণীয়: প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব বেশী তওবা-ইস্তেগফার করতেন। যেমন আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
وَاللَّهِ إِنِّى لأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ فِى الْيَوْمِ أَكْثَرَ مِنْ سَبْعِينَ مَرَّةً
“আল্লাহর শপথ, আমি দিনে সত্তর বারের অধিক আল্লাহর নিকট তওবা-ইস্তেগফার করি।”
সহীহ বুখারী। অনুচ্ছেদ: দিনে-রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তওবা, হা/৫৮৩২, শামেলা
সহীহ মুসলিমে আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ فَإِنِّي أَتُوبُ فِي الْيَوْمِ إِلَيْهِ مِائَةَ مَرَّةٍ
“হে মানব মণ্ডলী, তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর। কেননা, আমি দিনে একশ বার তওবা করি।”
[সহীহ মুসলিম, অনুচ্ছেদ: অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার করা মুস্তাহাব, হা/৪৮৭১]
তওবার শর্তাবলীঃ
জেনে রাখা দরকার যে, তওবার জন্য কতিপয় শর্ত রয়েছে। এ সকল শর্ত সাপেক্ষে কেবল তওবা কবুল হতে পারে; অন্যথায় নয়। গুনাহ যদি বান্দা ও আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়; অপর কোন মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট না হয় তবে তার জন্য তিনটি শর্ত। অর্থাৎ কেবল মুখে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ (আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি) পাঠ করলেই ক্ষমা পাওয়া যাবে না যতক্ষণ না চারটি শর্ত পূরণ করা হবে।
- ১ম শর্তঃ পাপ কর্মের জন্য লজ্জিত হওয়া।
- ২য় শর্তঃ তৎক্ষণাৎ পাপাচার হতে বিরত থাকা।
- ৩য় শর্তঃ পুনরায় উক্ত পাপ না করার জন্য আল্লাহর নিকট অঙ্গীকার করা।
- ৪র্থ শর্তঃ কারও অধিকার হরণ করে থাকলে তা পূর্ণ করা।
৪র্থ শর্তের ব্যাখ্যাঃ
যদি অন্যের জায়গা-জমি, অর্থ-কড়ি বা অধিকার হরণ করা হয়ে থাকে তাহলে উল্লেখিত তিনটি শর্তের সাথে চতুর্থ শর্ত হল, যার সম্পদ বা অধিকার হরণ করা হয়েছে তাকে তার সম্পদ/অধিকার ফেরত দেয়া। তবে তাকে না পাওয়া গেলে তা আল্লাহ পথে খরচ করে এ দুআ করবে যে, আল্লাহ যেন এর মালিককে এ দানের সওয়াব দান করেন। তবে পরবর্তীতে তার অথবা তার কোনও উত্তরসূরির সন্ধান পাওয়া গেলে তাদেরকে উক্ত পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে।
আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন।
তাওবা-ইস্তেগফার এর জন্য দুআঃ
হাদিসে বর্ণিত তাওবার কতিপয় দোয়াঃ
দোয়া ১ঃ
أَستَغْفِرُ اللهَ
উচ্চারণঃ আস্তাগফিরুল্লা-হ।
প্রতি ওয়াক্তের ফরয সালাতে সালাম ফিরানোর পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দোয়া ৩ বার পড়তেন। [মিশকাত-৯৬১]
অনুবাদঃ আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
দোয়া ২ঃ
أَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণঃ আস্তাগফিরুল্লা-হা ওয়া আতূবু ইলাইহি।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) প্রতিদিন ৭০ বারের অধিক তাওবা ও ইসতিগফার করতেন। [বুখারী-৬৩০৭]
অনুবাদঃ আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি ও তাঁর দিকে ফিরে আসছি।
দোয়া ৩ঃ
رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَتُبْ عَلَيَّ إِنَّكَ أنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ الغَفُوْرُ
উচ্চারণঃ রাব্বিগ্ ফিরলী, ওয়া তুব ‘আলাইয়্যা, ইন্নাকা আনতাত তাওয়া-বুর রাহীম। দ্বিতীয় বর্ণনয় “রাহীম”-এর বদলে: ‘গাফূর’।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে বসে এক বৈঠকেই এই দোয়া ১০০ বার পড়েছেন। [আবূ দাঊদ-১৫১৬, ইবনু মাজাহ-৩৮১৪, তিরমিযী-৩৪৩৪, মিশকাত-২৩৫২]
অনুবাদঃ হে আমার প্রভু, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি মহান তাওবা কবুলকারী করুণাময়।
দ্বিতীয় বর্ণনায়: তাওবা কবুলকারী ও ক্ষমাকারী।
দোয়া ৪ঃ
أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণঃ আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা- ইলা-হা ইল্লা- হুওয়াল হাইয়্যুল কইয়্যূম ওয়া আতূবু ইলায়হি।
এই দোয়া পড়লে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন-যদিও সে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়নকারী হয়। [আবু দাউদ-১৫১৭, তিরমিযী-৩৫৭৭, মিশকাত-২৩৫৩]
অনুবাদঃ আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, তিনি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন মা‘বূদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী এবং তাঁর কাছে তাওবাহ্ করি।
দোয়া ৫ঃ
اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা আনতা রব্বী লা-ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্কতানী ওয়া আনা আ’বদুকা ওয়া আনা আ’লা আহ্দিকা ওয়া ও’য়াদিকা মাসতাত’তু আ’উযুবিকা মিন শার্রি মা ছা’নাতু আবূউলাকা বিনি’মাতিকা আ’লাইয়্যা ওয়া আবূউলাকা বিযানবী ফাগ্ফির্লী ফাইন্নাহু লা-ইয়াগফিরুয্যুনূবা ইল্লা আনতা
এই দোয়া সকালে পড়ে রাতের আগে মারা গেলে অথবা রাতে পড়ে সকালের আগে মারা গেলে সে জান্নাতে যাবে। [বুখারী-৬৩০৬]
অনুবাদঃ হে আল্লাহ তুমিই আমার প্রতিপালক। তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমারই গোলাম। আমি যথাসাধ্য তোমার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের উপর আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি। তুমি আমার প্রতি তোমার যে নিয়ামত দিয়েছ তা স্বীকার করছি। আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। কারন তুমি ছাড়া কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারবে না।
আরও পড়ুনঃ অতীত জীবনের সকল পাপের তওবা
আল্লাহ আমাদেরকে সকল পাপ থেকে দূরে থাকার ও আমাদের জীবনে কৃত সকল পাপের জন্য তওবা-ইস্তিগফার করত গুনাহ থেকে মাফ পাওয়ার তৌফিয়ক দান করুন। আমিন
উত্তর প্রদানেঃ
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।