প্রশ্ন: আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব কয়েকদিন ধরে একটি কাজ শুরু করেছে। তা হল, ফজরের ফরজ সালাত শেষে উচ্চস্বরে আয়াতুল কুরসি, সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত, সূরা ইখলাস,ফালাক,নাস, দুবার দরুদ শরিফ (তাও দরুদে ইবরাহিম নয়) এর পরে উচ্চস্বরে মুসল্লিদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করে। এটি ঠিক কি না?
আমি তাকে গোপনে সূরা আরাফের ২০৪ ও ২০৫ আয়াত দেখিয়েছি। কিন্তু তিনি তা মানলেন না। উচ্চস্বরে পড়ার কারণে আমরা যারা নীরবে জিকির করি আমাদের ভুল হয়। এ ক্ষেত্রে কী করার আছে? আর দলীয়ভাবে কুরআন পড়ারও বিধান আছে কি না?
উত্তরঃ সালাত শেষ করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশ কতিপয় দুআ ও জিকির নিয়মিত পাঠ করতেন এবং তার উম্মতকে সেগুলো শিক্ষা দিয়েছেন। বিশেষ করে ফরজ সালাতের পর সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বে সকালের দুআ ও জিকিরগুলো পাঠ উত্তম। এ সব দুআ ও জিকির বিভিন্ন হাদিসের কিতাবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। আমাদের কর্তব্য, এগুলো প্রত্যেকেই নিজে নিজে আন্তরিকতা ও মনোযোগ সহকারে প্রতিনিয়ত যথাসাধ্য আমল করা।
মসজিদে এমন উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত, জিকির, দোআ, তসবিহ ইত্যাদি পাঠ করা উচিত নয়, যাতে অন্যান্য মুসল্লি বা জিকির রত লোকদের ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।
সুন্নতি পদ্ধতি হল, প্রত্যেকেই অন্তরে ভয়ভীতি জাগ্রত রেখে কুরআনের শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত করার মন মানসিকতা নিয়ে অর্থ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জেনে-বুঝে কুরআন তিলাওয়াত করা এবং সহিহ সনদে হাদিসে বর্ণিত দোয়া ও জিকিরগুলো পাঠ করা।
◉ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
ٱدۡعُواْ رَبَّكُمۡ تَضَرُّعٗا وَخُفۡيَةًۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُعۡتَدِينَ
সূরা আরাফ: ৫৫
“তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাক, কাকুতি-মিনতি করে এবং সংগোপনে। তিনি সীমা অতিক্রমকারীদেরকে পছন্দ করেন না।”
◉ তিনি আরও বলেনঃ
وَاذْكُر رَّبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ وَلَا تَكُن مِّنَ الْغَافِلِينَ
সূরা আরাফ: ২০৫
“আর সকালে ও সন্ধ্যায় তোমার রবের জিকির করো মনে মনে সবিনয়ে, সভয়ে ও অনুচ্চস্বরে আর উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।”
◉ হাদিসে এসেছেঃ
عن أبي سعيدٍ قالَ اعتَكفَ رسولُ اللَّهِ صلَّى اللَّهُ عليْهِ وسلَّمَ في المسجدِ فسمِعَهم يجْهَرونَ بالقراءةِ فَكشفَ السِّترَ وقالَ ألا إنَّ كلَّكم مُناجٍ ربَّهُ فلا يؤذِيَنَّ بعضُكم بعضًا ولا يرفعْ بعضُكم على بعضٍ في القراءةِ أو قالَ في الصَّلاةِ.
সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১৩৩২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস: ১১৬৫; মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১১৮৯৬; মুস্তাদরাকে হাকেম ১/৩১০
আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে (মসজিদে নববী) ইতিকাফ করছিলেন। এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন, লোকেরা উঁচু স্বরে কুরআন তিলাওয়াত করছে। তখন তিনি পর্দার কাপড় সরিয়ে তাদের লক্ষ্য করে বললেন, “মনে রাখবে, তোমাদের সবাই তার পালনকর্তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নিমগ্ন রয়েছ। অতএব তোমাদের একজন অপরজনকে কষ্ট দিবে না এবং তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে (অথবা তিনি বলেছেন: সালাতের ক্ষেত্রে) একজন অপরজনের উপর আওয়াজ উঁচু করবে না।”
◉ শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. এর বক্তব্যঃ
قد سُئل شيخ الإسلام ابن تيمية رحمه الله تعالى عن الدعاء بعد الصلاة، فذكر بعض ما نقل عنه صلى الله عليه وسلم من الأذكار بعد المكتوبة، ثم قال: وأما دعاء الإمام والمأمومين جميعاً عقيب الصلاة فلم ينقل هذا أحد عن النبي صلى الله عليه وسلم. انته
মজমু ফাতাওয়া শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, ২২/৫১৫
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.কে সালাতের পর দুআ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ফরয সালাতের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত কতিপয় যিকির উল্লেখ করার পর বলেন: “আর সালাতের পর ইমাম-মামুম (মুক্তাদি) সবাই মিলে দুআ করার কথা কেউই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন নি।”
◉ ইমাম নওবী রাহ. এর বক্তব্যঃ
أما ما اعتاده الناس أو كثير منهم من تخصيص دعاء الإمام بصلاتي الصبح والعصر، فلا أصل له.
মাজমু নওবী ৩/৪৬৫-৪৬৯
ইমাম নওবী রাহ. মাজমু গ্রন্থে বলেন: “আর লোকজন বা অনেক মানুষ ইমাম কর্তৃক ফরজ ও আসর সালাতের বিশেষ কিছু দুআকে নির্দিষ্ট করা-যা লোকেরা বা অনেক মানুষ নিয়োম বানিয়ে ফেলেছে তার কোন ভিত্তি নাই।”
সুতরাং আমাদের সমাজের ইমাম সাহেবগণ ফরয সালাতের পর (বিশেষ করে ফজর ও আসর সালাতের পর) মুসল্লিদেরকে নিয়ে যেভাবে সম্মিলিতভাবে সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত, জিকির-আজকার, মিলাদ ও দুআ-মুনাজাত করেন তা নিঃসন্দেহে বিদআত। কেননা তা যিকিরের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের আমল ও তরিকা পরিপন্থী।
🌀 তালিম বা শিখানোর উদ্দেেশ্যে সম্মিলিত কুরআত তিলাওয়াত বা দুআ ও যিকির পাঠ করার বিধানঃ
যদি লোকজনকে শেখানো (তালিম) বা মুখস্থ করানোর উদ্দেশ্যে সম্মিলিতভাবে কিছু দুআ ও সূরা পাঠ করানো হয় তাহলে তা জায়েজ আছে। যেভাবে মাদরাসা ও মক্তবে ছোট বাচ্চাদেরকে বিভিন্ন সূরা ও দুআ মুখস্থ করানো হয়। উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়ে গেলে তা বন্ধ করতে হবে।
তবে এক্ষেত্রে যেন অন্য ইবাদতকারীদের ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশের মসজিদগুলোতে সাধারণত যেভাবে নিয়ম করে মাথা ঝুঁকিয়ে, হেলে দুলে, চিৎকার করে সম্মিলিতভাবে আল্লাহ.. আল্লাহ…ইল্লাল্লাহ… ইল্লাল্লাহ… ইত্যাদি জিকির করা হয় বা সুললিত কণ্ঠে আরবি, বাংলা ও উর্দু ভাষায় ছন্দ, গজল, কবিতা আবৃতি আর কিছু দুআ-দরুদের সংমিশ্রণে মিলাদ-কিয়াম করা করা হয় তাতে লোকজনকে শেখানোর উদ্দেশ্যে থাকে না বরং ইবাদত করাই উদ্দেশ্য থাকে-এটা বলাই বাহুল্য।
সুতরাং এভাবে সম্মিলিত দুআ-মুনাজাত ও জিকির-আজকার বিদআত হওয়ার ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নাই।
আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের বিশুদ্ধ জ্ঞান দান করুন। আমীন।
🌀 ফজরের পরে সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পড়ার ফজিলত সম্পর্কিত হাদিসঃ
ফজরের পরে সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পড়ার ফজিলত সম্পর্কিত হাদিস টি মুহাদ্দিসদের দৃষ্টিতে সর্বসম্মতিক্রমে জঈফ বা দুর্বল। সুতরাং সহিহ সনদে বর্ণিত এত এত জিকির, দুআ ও আমল থাকার পরও কেন এ সব জঈফ ও অগ্রহণযোগ্য আমলের পিছে ছুটতে হবে তা বোধগম্য নয়।
আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়েত দান করুন। আমীন।
উত্তর প্রদান:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব
Comments
One response to “ফরজ সালাত এর পর প্রচলিত মুনাজাত ও বিভিন্ন দুয়া সম্পর্কে”
[…] আরও পড়ুনঃ ফরজ সালাত এর পর প্রচলিত মুনাজাত ও বিভি… […]