প্রশ্নঃ ইসলামি শরিয়তে ‘শবে মেরাজ’ উপলক্ষে বিশেষ নামাজ-রোজা ও ইবাদত-বন্দেগির ভিত্তি কতটুকু?
উত্তরঃ নিম্নে এ বিষয়ে অতিসংক্ষপে আলোকপাত করা হল। তৎসঙ্গে এ সময়ের সাড়া জাগানো কয়েকজন বাংলাভাষী শাইখদের বক্তব্যও উপস্থাপন করা হল।
শবে মেরাজ উপলক্ষে বিশেষ কোন নামাজ, রোজা, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা, লোকজন জমায়েত, ভোজ অনুষ্ঠান, কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন খতম, শব বেদারি (নিশী জাগরণ), দুআ মাহফিল, হালকায়ে জিকির, নাতে রাসূল ও ইসলামি গজল সন্ধ্যা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, মসজিদ ইত্যাদি আলোকসজ্জা করা ইত্যাদি কোন কিছুই করা শরিয়ত সম্মত নয়।
কারণ হাদিসে এ মর্মে কোন কিছুই আসেনি। সাহাবায়ে কেরাম কখনো এ উপলক্ষে কোনও আয়োজন-অনুষ্ঠান, রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি ইত্যাদি করেছেন বলে হাদিসের কিতাবগুলো প্রমাণ করছে না।
ইবনুল কাইয়েম জাওযিয়া রহ. বলেন,
قال شيخ الإسلام ابن تيمية – رحمه الله -: ولا يعرف عن أحد من المسلمين أن جعل لليلة الإسراء فضيلة على غيرها، لاسيما على ليلة القدر، ولا كان الصحابة والتابعون لهم بإحسان يقصدون تخصيص ليلة الإسراء بأمر من الأمور ولا يذكرونها، ولهذا لا يعرف أي ليلة كانت
“ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, পূর্ববর্তী যুগে এমন কোন মুসলিম পাওয়া যাবে না যে, শবে মেরাজকে অন্য কোন রাতের উপর মর্যাদা দিয়েছে। বিশেষ করে শবে কদরের চেয়ে উত্তম মনে করেছে এমন কেউ ছিল না। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের একনিষ্ঠ অনুগামী তাবেঈনগণ এ রাতকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন কিছু করতেন না এমনকি তা আলাদাভাবে স্মরণও করতেন না। যার কারণে জানাও যায় না যে, সে রাতটি কোনটি।”
[উৎস: আল বিদা’ আল হাওলিয়া পৃষ্ঠা ২৭৪]
ইবনুল হাজ্জ বলেন,
ومن البدع التي أحدثوها فيه أعني في شهر رجب ليلة السابع والعشرين منه التي هي ليلة المعراج
“রজব মাসে যে সকল বিদআত আবিষ্কৃত হয়েছে সগুলোর মধ্যে সাতাইশ তারিখের লাইলাতুল মেরাজ (শবে মেরাজ) অন্যতম।”
মোটকথা, আমাদের দেশে কথিত শবে মেরাজ উপলক্ষে ঘটা করে যে সব কার্যক্রম করা হয় তা দীনের মধ্যে নবসৃষ্ট বিদআত। আর বিদআত মানেই ভ্রষ্টতা। ভ্রষ্টতা মানেই জাহান্নামের পথ।
সুতরাং প্রতিটি মুসলিমের জন্য দীনের মধ্যে নব আবিস্কৃত সকল বিদআতি কার্যক্রম থেকে দূরে থাকা ফরজ।
ইশা সালাতের ওয়াক্ত (সময়) শুরু ও শেষ কখন? ইশা সালাত আদায়ে একটু দেরী হয়ে গেলে সমস্যা হবে কি? মধ্যরাত পর্যন্ত সময় থাকে নাকি ফজরের আগ পর্যন্ত সময় থাকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন।
উত্তরঃ মাগরিবের সময় শেষ হওয়ার সাথে সাথেই (অর্থাৎ পশ্চিম দিগন্তের লাল আভা অদৃশ্য হওয়ার সাথে সাথে) ইশার ওয়াক্ত শুরু হয় এবং মধ্যরাত পর্যন্ত তা বিদ্যমান থাকে।
‘আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘আসরের সলাতের ওয়াক্ত না হওয়া পর্যন্ত যোহরের সলাতের ওয়াক্ত থাকে। আর সূর্য বিবর্ণ হয়ে সোনালি বা তাম্রবর্ণ ধারণ করা পর্যন্ত আসরের সলাতের ওয়াক্ত থাকে। সন্ধ্যাকালীন গোধূলি বা পশ্চিম দিগন্তের রক্তিম আভা অন্তর্হিত না হওয়া পর্যন্ত মাগরিবের সলাতের ওয়াক্ত থাকে। ইশার সলাতের সময় থাকে অর্ধ-রাত্রি পর্যন্ত। আর ফজরের সলাতের সময় থাকে যতক্ষণ সূর্যোদয় না হয়।”
সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: মসজিদ ও সালাতের স্থানসমূহ, অধ্যায়: পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সলাতের সময়, হা/১২৭৩০
ব্যতিক্রমঃ
তবে কেউ যদি ভুলে যায় অথবা ঘুমের কারণে যথাসময়ে পড়তে না পারে তাহলে যখনই তার স্মরণ হবে হবে বা ঘুম ভাঙ্গবে তখনোই কাল বিলম্ব না করে তা আদায় করবে তাহলে গুনাহ হবে না। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবে অর্ধরাত্রি অতিক্রম করে ইশার নামায পড়া জায়েয নাই।
অবশ্য কিছু আলেমের মতে, জরুরত বশত: ফরজের আগ পর্যন্ত পড়া জায়েয রয়েছে। অর্থাৎ বিশেষ প্রয়োজন বশত: ফরজ হওয়া আগ পর্যন্ত জায়েয। তবে ইচ্ছাকৃত ভাবে এমনটি করা ঠিক নয়।
কিন্তু শক্তিশালী দলীল থাকার কারণে প্রথম অভিমতটি অধিক অগ্রাধিকার যোগ্য। সতর্কতা বিবেচনায়ও এটি অধিক গ্রহণযোগ্য। কেননা সালাতের মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের ক্ষেত্রে সর্তকতা কাম্য।
সুতরাং সর্বাধিক সঠিক কথা হল, ইশার সালাতের শেষ সময় হল, অর্ধরাত্রি। এর পরে আদায় করলে তা কাযা হিসেবে গণ্য হবে। [এ মত ব্যক্ত করেছেন আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালিহ আল উসাইমীন রহ (শারহুল মুমতি ২/৫৩)]
মধ্যরাত নির্ধারণের পদ্ধতি কি?
মধ্যরাত নির্ধারণের পদ্ধতি হল, সূর্যাস্ত থেকে ফজরের সময় হওয়ার সময় হিসাব করে এর ঠিক মধ্যবর্তী সময়টা মধ্যরাত্রি তথা ইশার নামাযের শেষ ওয়াক্ত।
উদাহরণ: সূর্য যদি সন্ধ্যা ৫টায় অস্ত যায় আর ফজরের সময় হয় ভোর ৫টায়। তাহলে তার মানে হল, মধ্যরাত রাত ১১টা। অনুরূপভাবে, সন্ধ্যা ৫ টায় সূর্য অস্ত গিয়ে ভোর ৬টায় ফজর হলে মধ্যরাত্রি হবে রাত ১১.৩০ মি:।
প্রশ্নঃ সালাতে সতর তথা শরীরের কতটুকু ঢাকা আবশ্যক? হাফ প্যান্ট পরিহিত (হাঁটু ঢাকা অবস্থায়) বা হাফ শার্ট/টি শার্ট পরিধান করে সালাত আদায় করলে তা কি শুদ্ধ হবে?
উত্তরঃ সালাতে পুরুষদের ন্যূনতম সতর হল, দু কাঁধ এবং নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা। অর্থাৎ সর্ব নিম্ন এতটুকু ঢাকা থাকা সালাত শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত।
অবশ্য কাঁধ ঢাকা শর্ত কি না এ ব্যাপারে সম্মানিত ফকিহদের মাঝে দ্বিমত রয়েছে। তবে একাধিক বিশুদ্ধ হাদিসের আলোকে সালাতে দু কাঁধ ঢাকার মতটি অধিক শক্তিশালী বলে প্রতিয়মান হয়। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ لاَ يُصَلِّ أَحَدُكُمْ فِي الثَّوْبِ الْوَاحِدِ لَيْسَ عَلَى مَنْكِبَيْهِ مِنْهُ شَىْءٌ ”
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের কেউ যেন কাঁধ খোলা রেখে এক কাপড়ে সালাত আদায় না করে।”
সহীহ বুখারী ও মুসলিম
হাদিসে আরও বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ فِي ثَوْبٍ فَلْيُخَالِفْ بِطَرَفَيْهِ عَلَى عَاتِقَيْه ”
আবু হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের কেউ এক কাপড়ে সলাত আদায় করলে সে যেন কাপড়ের ডান পাশকে বাম কাঁধের উপর এবং বাম পাশকে ডান কাঁধের উপর ঝুলিয়ে রাখে।”
সহীহ মুসলিম
এ হাদিসদ্বয় থেকে দু কাঁধ ঢাকার মতটি অধিক শক্তিশালী বলে প্রতিয়মান হয়। অবশ্য যে সকল ফকিহগণ কাঁধ ঢাকার বিষয়টিকে আবশ্যক মনে করে না তাদের মতে, কাঁধ ঢাকা সালাতের একটি সৌন্দর্য বা আদব মাত্র; এর বেশি নয়। যা হোক, একান্ত জরুরি পরিস্থিতির শিকার না হলে ইচ্ছাকৃতভাবে দু কাঁধ খোলা রেখে সালাত আদায় করা ঠিক নয়।
উল্লেখ্য যে, মহিলাদের জন্য পর পুরুষ দেখার সম্ভাবনা না থাকলে মুখ মণ্ডল ও দু হাতের কব্জি ব্যতিরেকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত সারা শরীর ঢাকা আবশ্যক। আর পর পুরুষ দেখার সম্ভাবনা থাকলে মুখ ও হাতের কব্জি দ্বয়ও ঢাকতে হবে।
সুতরাং কোন পুরুষ যদি একটি গামছা/তোয়ালে দ্বারা তার দু কাঁধ ঢাকে বা হাফ শার্ট বা টি শার্ট পরিধান করে এবং এতটুকু লম্বা হাফ প্যান্ট পরিধান করে যে, তার নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে যায় তাহলে তাতে সালাত শুদ্ধ হবে ইনশাআল্লাহ।
তবে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সালাতে এত ছোট পোশাক পরা উচিৎ নয় বরং সারা শরীর সুন্দরভাবে আবৃত করত: শালীন ও রুচি সম্মত জামা-কাপড় পরিধান করাই সালাতের সৌন্দর্য ও আদব।
প্রশ্নঃ রমাযান মাসে যদি হায়েয হয়ে যায়, তাহলে কি কি করণীয়? এছাড়া কি কি থেকে দূরে থাকতে হবে?
উত্তরঃ হায়েজ অবস্থায় একজন মহিলার জন্য বেশ কিছু কাজ বৈধ্য নয়। আবার বেশ কিছু কাজ বৈধ্য। সেগুলি রমাযান এবং রমাযানের বাহিরে একই।
হায়েয অবস্থায় বৈধ নয় সেগুলো হলঃ
🔹 একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কুরআত তিলাওয়াত করা বা আবরণ ছাড়া কুরআন স্পর্ষ করা 🔹 কাবা ঘর তাওয়াফ 🔹 মসজিদে দীর্ঘ সময় অবস্থান করা 🔹 স্বামীর সাথে সহবাস করা 🔹 সালাত ও সিয়াম আদায় না করা 🔹 পরর্বতীতে সালাত কাজা করার প্রয়োজন নাই তবে সিয়ামগুলো কাজা করা আবশ্যক।
হায়েজ অবস্থায় বৈধ কাজ গুলিঃ
এ ছাড়া যত প্রকার ইবাদত আছে সবই করা জায়েয আছে। যেমন: কুরআনের তাফসীর পড়া (তবে কুরআনে মূল টেক্সগুলো পড়া যাবে না), হাদীসের বই পড়া, ইসলামী বই-পুস্তক পড়া, ইসলামী জ্ঞানার্জন করা, কুরআন তিলাওয়াত শুনা, ইসলামী আলোচনা শুনা, দুআ ও যিকির সমূহ পাঠ করা।
ব্যতিক্রমঃ
এমন কি দুআ ও যিকির হিসেবে বা রুকিয়া (ঝাড়ফুঁক) এর প্রয়োজনে কুরআনের আয়াত ও সূরা (যেমন সূরা ইখলাস, ফালাক, নাস, আয়াতুল কুরসী ইত্যাদি) পড়াও জায়েয আছে।
প্রশ্নঃ আমাদের সমাজে নারী এবং পুরুষ দুই ভাবে সিজদা করে। মেয়েরা দুই হাত ও শরীর জমিনের সাথে লেপ্টিয়ে সিজদা করেন, আর পুরুষরা লেপ্টে দেন না। জানতে চাচ্ছি নামাজ/সালাত এর মধ্যে মহিলারা কিভাবে সিজদা দিবে?
উত্তরঃ আমাদের সমাজে প্রচলিত পদ্ধতিতে মহিলারা শরীর লেপ্টিয়ে বিছিয়ে দেন জমিনে, দুই হাত মিলিয়ে দেন জমিনে যা স্পষ্ট হাদিস বিরোধী এবং তা পরিতাজ্য।
🌀 রাসুল (সাঃ) দুই হাত মাটিতে বিছিয়ে দিতেন না। বরং তা জমিন থেকে উপরে (বুখারী, আবু দাউদ) এবং পেটের দুই পাশ থেকে দুরে রাখতেন। (বুখারী, মুসলিম)
🌀 হাটু, পেট, হাত, মাথা এই অঙ্গগুলোর মাঝখানে এমন ফাঁকা থাকতে হয় যেন এই ফাকা দিয়ে একটি বকরীর বাচ্চা চলে যেতে পারে| (সহিহ মুসলিম)
আমাদের সমাজে দেখা যায় নারী এবং পুরুষের সালাতে পার্থক্য করা হয়। পুরুষরা একভাবে সালাত আদায় করেন, আর নারীরা অন্য ভাবে সালাত আদায় করেন। আসলেই কি নারী ও পুরুষের সালাতে কি কোন পার্থক্য আছে? বিস্তারিত জানালে উপকৃত হবো ইনশাআল্লাহ।
নারী পুরুষের সালাতে পার্থক্য – বাস্তবতাঃ
ঠিক মতানুযায়ী নারী-পুরুষের নামাযের পদ্ধতিগত কোন পার্থক্য নেই। যেমন, কিয়াম, কিরাআত, রুকু, সিজদা, তাশাহুদ, সালাম ইত্যাদি।
কিন্তু কিছু বিষয়ের পার্থক্য হাদীস দ্বারা প্রমানিত। তন্মধ্যে, আযান, একামত, জামাআতে নামায, মাসজিদে গমণ, জুমার নামায ইত্যদি কেবল পুরুষদের জন্য; মহিলাদের জন্য নয়। অনুরূপভাবে পর্দা, নামাযের ইমামতি, ইমামের ভুল সংশোধন ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের পার্থক্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
রাসূল (ছাঃ) এর সালাত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছিল একথা ভাববার কোন অবকাশ নেই। পুরুষ ও মহিলা সালাতের মধ্যে পদ্ধতিগত কোন পর্থক্য নেই। সতর বা পর্দার যে বিষয়টি মেয়েদের সালাতের বিষয়ে বিভিন্ন নামায শিক্ষা বইতে এসেছে তা মেয়েদের পূর্ণাঙ্গ পর্দার মধ্যে সালাত আদায়ের নির্দেশই যথেষ্ট। এতে নতুন করে যুক্তি পেশ করার প্রয়োজন নেই।
আমাদের মধ্যে যঈফ ও জাল হাদীসের অনুকরণে সালাত চালু থাকার কারণে এবং বিভিন্ন মাযহাব পন্থীর গোড়ামীর কারণে বিভিন্ন নিয়ম চালু হয়ে গিয়েছে। এজন্য আমাদের সমাজের মহিলারা কিংবা পুরুষেরা মনে করে, তাদের সালাত আলাদা। কিন্তু বাস্তবে পুরুষ মহিলাদের সালাতের মধ্যে পদ্ধতিগত কোন পার্থক্য নেই এবং এ ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীসও বর্ণিত হয়নি।
সালাত আদায় করার জন্য নারী পুরুষ কারোর জন্য স্বতন্ত্র নিয়ম করা হয়নি। জিবরাঈল (আঃ) মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ ক্রমে দুই দফায় রাসূল (সাঃ)-কে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের নিয়ম পদ্ধতি ইমামতি করে বাস্তবভাবে শিখিয়ে গেছেন। এ সময় জিবরাঈল (আঃ) নারীদের সালাতের জন্য আলাদা কোন নিয়ম পদ্ধতির বর্ণনা দেন নাই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষের জন্য এ নমুনা শিখানো হয়েছে। আল্লাহর নিয়ম পদ্ধতিতে কখনও কোন পার্থক্য দেখা যাবে না।
এ মর্মে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আর আপনি আল্লাহর নিয়ম-রীতিতে কখনও কোন পরিবর্তন পাবেন না।”
সূরা-আহযাব : আয়াত-৬২
(নারী-পুরুষ উভয় জাতির) উম্মতকে সম্বোধন করে রাসূল(ছাঃ) বলেছেন, “তোমরা সেইরুপ সালাত আদায় কর, যেইরুপ আমাকে করতে দেখেছ”।
বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬৮৯
উল্লেখ্য হাদীসটি উম্মে দারদা(রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি একজন ফকীহাও ছিলেন।
আলাদাভাবে বলা হয়নি। সুতরাং যে আদেশ শরীয়ত পুরুষদেরকে করেছে, সে আদেশ নারীদেরকেও করেছে। এবং যে সাধারণ আদেশ মহিলাদের তাও পুরুষদের ক্ষেত্রে পালনীয়- যদি বিশেষ হওয়ার ব্যাপারে কোন প্রকার দলীল না থাকে। যেমন,
যারা সতী মহিলাদের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে, অতঃপর চারজন স্বাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদের জন্য শাস্তি হল ৮০ কোড়া- —।
কুরআন-২৪/৪
পরন্ত যদি কেউ কোন সৎ পুরুষকে অনুরুপ অপবাদ দেয়, তবে তার জন্য একই শাস্তি প্রযোজ্য।
সুতরাং মহিলারাও তাদের সালাতে পুরুষদের মতই হাত তুলবে। পিঠ লম্বা করে রুকু করবে, তাশাহুদেও সেইরুপ বসবে, যেরুপ পুরুষরা বসে।
মসজিদে নববীতে নারী পুরুষ সকলে রাসূল(ছাঃ) এর (ইমামতি) পিছনে একই নিয়মে সালাত ও জুম’আ আদায় করেছেন।
বুখারী, মিশকাত হা/৯৪৮, মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০৯
উম্মে দারদা (রাঃ) তার সালাতে পুরুষের মতই বসতেন। আর তিনি একজন ফকীহা ছিলেন।
মহিলাদের জন্য পুরুষদের ন্যায় মুস্তাহাব আর তা হলো, ডান পা খাড়া করে রাখবে এবং বাম পা বিছিয়ে রাখবে। এটা ইমাম নাসাঈ, ইমাম আবূ হানীফা এবং ইমাম মালিক (রহঃ) এর উক্তি।
আইনী ৩য় খন্ড ১৬৫ পৃষ্ঠা
ইবরাহীম নাখয়ী (রঃ) বলেন, ‘সালাতে মহিলারা ঐরুপ করবে, যেরুপ পুরুষরা করে থাকে।
ইবনু আবী শাইবাহ, সিসান ১৮৯ পৃঃ
এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, সালাতের মধ্যকার ফরয ও সুন্নাত সমূহ মুসলিম নারী ও পুরুষ সকলে একই নিয়মে আদায় করতে হবে।
আর মহিলাদের জড়োসড়ো হয়ে সিজদাহ করার ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই।
সিযঃ ২৬৫২ নং
আলবানী বলেন,‘পুরুষ ও মহিলাদের সালাতের পার্থক্য সম্পর্কে আমি একটিও সহীহ হাদীস জানি না। এটা ব্যক্তি রায় ও ইজতিহাদ মাত্র।
সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৫০০ এর আলোচনা দ্রঃ
বেগানা পুরুষ আশে পাশে থাকলে কির’আত পাঠের ক্ষেত্রে (জেহরী সলাতে) মহিলা সশব্দে কুরআন পড়বে না। তবে না থাকলে পড়তে হবে।
আল মারআতুল মুসলিমাহ ৩/৩০৪
সুনিদৃষ্ট সহীহ দলীলের ভিত্তিতে মহিলা ও পুরুষের সালাতে কিছু পার্থক্য?
ক.মহিলারা মহিলা জাম‘আতে ইমামতি করলে প্রথম কাতারের মাঝখানে দাড়াবে।‘আম্মার দুহনী হতে বর্ণিত, তিনি তার বংশের জনৈক মহিলা যার নাম হুজায়রাহ হতে বর্ণনা করেন,তিনি উম্মে সালামা হতে বর্ণনা করেন। উম্মে সালামা(রাঃ) তাদের ইমামতি করতেন এবংতাদের মাঝ বরাবর দাঁড়াতেন। (সুনানুল কুবরা হা/৫৫৬৩;আয়নুল মা‘বুদ ২খন্ড ২১২পৃঃ)।
খ.সালাতে ইমামের ভুল স্মরণ করাবার জন্য ডান হাত দ্বারা বাম হাতে মেরে আওয়াজ দিয়ে স্মরণ করাবে। (বুখারি হা/১২০৩)
ছ. জাম‘আতে সালাত আদায় কালীন পুরুষদের মাথা উঠানোর পর মহিলারা মাথা উঠাবে। সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,“তহবন্দ ——-খাটো —হে নারী সমাজ। পুরুষরা তাদের মাথা উত্তোলন না করা পর্যন্ত তোমরা সাজদা হতে তোমাদের মাথা উত্তোলন করবে না।’(মুসলিম ১/১৮২পৃঃ হা/৬৬৫)
মহিলা ও পুরুষের সালাত পার্থক্যের কতিপয় বর্ণণা ?
বিভিন্ন সালাত শিক্ষা বইয়ে পুরুষ ও মহিলাদের সালাতের মাঝে অনেক পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। কিছু দলীলও পেশ করেছেন। হাদীস বিদ্বানগনের বিশ্লেষন ও যাচাই বাছাই করলে দেখা যায় সে গুলো জাল ও যঈফ। পুরুষও মহিলার সালাতের পার্থেক্যের ব্যাপারে যে সমস্ত বর্ণনা গুলো পেশ করা হয় তার কয়েকটি নিম্নরুপঃ
১.ইয়াযিদ ইবনু আবী হাবীব বলেন, দু’জন মহিলা সালাত রত অবস্থায় রাসূল(ছাঃ) তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, সিজদাহর সময় তোমরা শরীরের কিছু অংশ মাটির সাথে ঠেকিয়ে দাও। কারন মহিলাদের সিজদাহ পুরুষের মত নয়। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩৩২৫) হাদীসটি যঈফ। (সিলসিলা যইফাহ হা/২৬৫২)।
বিশ্লেষণঃ উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে ইমাম বায়হাক্বী নিজেই বলেছেন, এই বিষয়ে দুইটি মারফূ’ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে কিন্তু কোনটিই নির্ভরযোগ্য নয়। (বায়হাক্বী, মা’রেফাতুস সুনান ওয়াল আছার হা/১০৫০)
আবূ দাউদ মিরাসালে এই মুরসাল বর্ণনাটি আছে তাও উক্ত সনদে ‘ইয়াযীদ বিন আবী হাবিব’ যঈফ রাবী। ‘মুরসাল’ বর্ণনা অগ্রহনযোগ্য । কারন যে সনদের শেষ ভাগে তাবেঈর পরের ব্যক্তি অর্থাৎ সাহাবীকে উহ্য রেখে তাবেঈ বলবেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, এরুপ সনদের হাদীসকে মুরসাল বলা হয়। (এর সমর্থনে কোন মারফু অথবা মাওকুফ হাদীস না থাকলে এরুপ বর্ণনা গ্রহনযোগ্য নয়)। তার পরও বর্ণনার সনদটি যঈফ। অতএব বর্ণনাটি আমলের প্রশ্নই ওঠে না।
একজন তাবেঈ রাসূল (ছাঃ) এর সঙ্গে কোন সাহাবার সুত্র ছাড়া তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন। (তাবেঈ তারাই, যারা রাসূল (ছাঃ) কে দেখেননি তবে সাহাবাদের থেকে হাদীস শিখেছেন এবং সহচর)।
২. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বলেন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন মহিলা যখন সালাতে বসবে তখন সে তার এক উরুর সাথে অন্য উরু লাগিয়ে রাখবে এবং যখন সে সিজদাহ দিবে তখন তার পেট দুই উরুর সাথে মিলিয়ে রাখবে যেন তা তার জন্য পর্দা স্বরুপ হয়। আর তখন আল্লাহতা‘আলা তা লক্ষ্য করেন এবং ফেরেশতাদেরকে ডেকে বলেন, তোমাদেরকে সাক্ষী রাখছি, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩৩২৪ ; ‘নবীজীর নামায’ ৩৩৭-৩৩৮ পৃষ্ঠা)।
বিশ্লেষনঃ উক্ত বর্ণনা যঈফ ইমাম বায়হাক্বী উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে নিজেই যঈফ বলেছেন এবং প্রত্যাখ্যান করেছেন। (সুনানুল কুবরা হা/৩৩২৪ এর আলোচনা)।
মাওলানা আব্দুল মালেক বায়হাক্বী থেকে বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন কিন্তু বর্ণনাটি যে যঈফ তা উল্লেখ করেননি। যঈফ বর্ণনা দ্বারা দ্বীনি আমলের মূল (বিধান) দলীল সাব্যস্ত হয় না।
ইমাম আহমাদের মাসায়েল গ্রন্থে ইবনে উমার থেকে নিজ স্ত্রীদের এক পায়ের উপর অন্য পা আড়াআড়ি করে বসার আদেশ সূচক যে বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে এই সনদের মধ্যে ‘আবদল্লাহ বিন উমরী ’নামক রাবী যঈফ।
৩. ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) বলেন, আমি একদা রাসূল (ছাঃ) এর নিকট আসলাম। তিনি সাহাবীদেরকে বললেন, এটা হল ওয়ায়েল বিন হুজর। সে তোমাদের কাছে উৎসাহে বা ভীতির কারণে আসেনি; বরং আল্লাহ ও তার রাসূল(ছাঃ) এর ভালোবাসার কারণে এসেছে। … ওয়ায়েল (রাঃ) বলেন, “তিনি আমাকে বললেন, তুমি যখন সালাত আদায় করবে তখন তোমার দুই হাত কান বরাবর উঠাবে। আর মহিলা মুছল্লী তার হাত বুক বরাবর উঠাবে।” (ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/১৭৪৯৭; নবিজীর নামাজ, ৩৭৯ পৃষ্ঠা)।
বর্ণনাটি নিতান্তই যঈফ মূলতঃ এর সনদে মায়মুনাহ বিনতে হুজর এবং উম্মু ইয়াহইয়া বিনতে আব্দুল জ্জাব্বার নামে দুই জন অপরিচিত রাবী আছে। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৫০০)।
নবিজীর নামাজ পৃষ্ঠা ৩৭৯-৩৮৮ তে উক্ত মর্মে সাহাবী ও তাবেঈর নামে আরো কতিপয় বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সবই মুনকার ও ভিত্তিহীন। সে গুলোর দিকে ভ্রুক্ষেপ করার কোন প্রয়োজন নেই।(জাল হাদিসের কবলে রাসূলুলাহ(ছাঃ) এর ছালাত পৃ-২১৬)।
মেয়েদের সালাত ভিন্ন হওয়ার ব্যাপারে গোড়ামী পন্থীদের কোন সুনির্দিষ্ট সহীহ দলীল নেই। মেয়েদের জড়োসড়ো হয়ে দাড়ানো থেকে সিজদাহ পর্যন্ত সবকিছুর ব্যাপারেই ইমাম কুদুরী (র.) মাযহাবের মত প্রকাশ করতে যেয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন এটা তাদের সতরের জন্য অধিক উপযোগী। (আল হেদায়া প্রথম খন্ড পৃঃ৮৫-৮৭)।
এছাড়া জাল হাদীস গুলোকে হাসান বলে ভিত্তিহীন কিছু কল্প কাহিনী ও কয়েকটি জাল যঈফ হাদীস সহ আমাদের দেশে মেডইন ইরাক, কুফা, পাকিস্থান, ভারত ইত্যাদি হাদীস পেশ করা হয়েছে বিভিন্ন নামাজ শিক্ষা বইতে এ সম্বন্ধে বিভিন্ন মন্তব্যও পাওয়া যায় যা আমলে অযোগ্য,সহীহ হাদীস বিরোধী।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন যে ব্যক্তি সালাতে নিজের উভয় পা(এক সঙ্গে) মিলিয়ে দাড়ালো সে সুন্নাতের বিরোধিতা করলো। (নাসাঈ হা/ ৮৯৫ ইঃ ফাঃ)।
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) এ রকম চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় মাটিতে দু’হাত বিছিয়ে সিজদাহ করতে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম, আবু দাউদ হা/৭৮৩)।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী (ছাঃ) বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন সিজদাহ দেওয়ার সময় দু‘হাত বিছিয়ে না দেয়, যেমন কুকুর বিছিয়ে দেয়। (বুখারী হা/৮২২, তাওহীদ প্রকাশনী, ইঃ ফাঃ ৭৮৪)।
প্রশ্ন: সেহরি খাওয়ার পূর্বে নিয়ত মুখে উচ্চারণ করার বিধান কি এবং আমরা কিভাবে নিয়ত করব?
উত্তরঃ সেহরি খাওয়ার পূর্বে নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা বিদআত। কেননা, হাদিসে নিয়ত করার কথা এসেছে কিন্তু মুখে উচ্চারণ করার কথা আসে নি। সালাত, সওম, যাকাত, হজ্জ, ওযু, গোসল ইত্যাদি কোনো ক্ষেত্রেই নয়।
সুতরাং নিয়তের নামে গদ বাধা কতগুলো আরবী বা বাংলা বাক্য উচ্চারণ করা দ্বীনের মধ্যে নতুন সংযোজন ছাড়া অন্য কিছু নয়। যার কারণে এ সকল গদ বাধা বাক্য মুখে উচ্চারণ করা জঘণ্য বিদআত হিসেবে অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কেননা প্রতিটি বিদআতই ভ্রষ্টতা আর প্রতিটি ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম। (আল্লাহ আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। আমীন।)
আমাদেরকে জানতে হবে যে, সেহরি খাওয়া একটি ইবাদত। আর যে কোনো ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য নিয়ত থাকা অপরিহার্য শর্ত। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
« إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ » “সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।”
সহীহ বুখারীর প্রথম হাদিস
তাই রোযা রাখার জন্য নিয়ত থাকা অপরিহার্য। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
কিন্তু জানা দরকার, নিয়ত কি বা কিভাবে নিয়ত করতে হয়?
🌀 নিয়ত কি বা কিভাবে নিয়ত করতে হয়?
ইমাম নববী রাহ. বলেন: “মনের মধ্যে কোন কাজের ইচ্ছা করা বা সিদ্ধান্ত নেয়াকেই নিয়ত বলা হয়।” সুতরাং রোযা রাখার কথা মনে মধ্যে সক্রিয় থাকাই নিয়তের জন্য যথেষ্ট। মুখে উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই। কেননা, ইসলামী শরীয়তে কোন ইবাদতের নিয়ত মুখে উচ্চারণের কথা আদৌ প্রমাণিত নয়।
অথচ আশ্চর্য জনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ওযুর নিয়ত, নামাযের নিয়ত, সেহরি খাওয়ার নিয়ত ইত্যাদি চর্চা করা হয়। নামায শিক্ষা, রোযার মাসায়েল শিক্ষা ইত্যাদি বইয়ে এ সব নিয়ত আরবিতে অথবা বাংলা অনুবাদ করে পড়ার জন্য জনগণকে শিক্ষা দেয়া হয়! কিন্তু আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, দ্বীনের মধ্যে এভাবে নতুন নতুন সংযোজনের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন। তিনি বলেন:
« مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ » “যে আমাদের এই দ্বীনে এমন নতুন কিছু তৈরি করল যা তার অন্তর্ভুক্ত নয় তা পরিত্যাজ্য।”
বুখারী ও মুসলিম
তাই মুসলমানদের কর্তব্য হল, দলীল-প্রমাণ ছাড়া গদ বাধা নিয়ত (নাওয়াই আন…..) সহ সব ধরণের বিদআতি কার্যক্রম পরিত্যাগ করা এবং সুন্নতকে শক্তভাবে ধারণ করা। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার এবং বিদআত বর্জন করার তওফিক দান করুন। আমীন।
সালাতে (নামাযে) সূরার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কতটুকু জরুরী এবং প্রথম রাকাতে বড় সূরা এবং পরের রাকাতে ছোট সূরা পড়ার বিষয়ে বিধি-বিধান কেমন হবে সে বিষয়ে আলোচনা।
প্রশ্ন: নামাযে সূরা পড়ার ক্ষেত্রে সূরা সমূহের ধারবাহিকতা রক্ষা না করলে কি নামায শুদ্ধ হবে না? আর আগের রাকাআতে ছোট সূরা এবং পরের রাকাআতে বড় সূরা পড়লে কি নামায বাতিল হয়ে যাবে বা সুন্নত লঙ্ঘণ করার কারণে গুনাহগার হতে হবে?
উত্তরঃ সালাতে কিরাআত পড়ার ক্ষেত্রে উত্তম হল, কুরআনের সূরার সমূহের ধারবাহিকতা রক্ষা করা (অর্থাৎ আগের সূরা আগে এবং পরেরটা পরে পড়া)।
এবং ১ম রাকাআতে বড় সূরা পড়লে তার পরের রাকাআতে তুলনা মূলক ছোট সূরা পড়া। তবে এর ব্যতিক্রম হলেও সালাত শুদ্ধ হবে। কেননা, কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ
“তোমার কুরআনের যেখান থেকে সুবিধা হয় পড়ো।”
সূরা মুযাম্মিল: ২০
সূরা আগে পরের করবার বিষয়ে হাদিস
তাছাড়া হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই রাকাআতে সূরা নিসা পড়ার পর সূরা আলে ইমরান পাঠ করেছেন। অথচ কুরআনের ধাবাবাহিকতা অনুযায়ী সূরা সূরা আলে ইমরানের পরে সূরা নিসা এর অবস্থান। হাদীস:
عَنْ حُذَيْفَةَ، قَالَ صَلَّيْتُ مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم لَيْلَةً فَافْتَتَحَ الْبَقَرَةَ فَقُلْتُ يَرْكَعُ عِنْدَ الْمِائَةِ فَمَضَى فَقُلْتُ يَرْكَعُ عِنْدَ الْمِائَتَيْنِ فَمَضَى فَقُلْتُ يُصَلِّي بِهَا فِي رَكْعَةٍ فَمَضَى فَافْتَتَحَ النِّسَاءَ فَقَرَأَهَا ثُمَّ افْتَتَحَ آلَ عِمْرَانَ فَقَرَأَهَا يَقْرَأُ مُتَرَسِّلاً
হুযায়ফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একরাত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সালাত আদায় করলাম। তিনি সূরা বাকারা শুরু করলেন, আমি মনে মনে বললাম যে, হয়তো তিনি একশত আয়াত পরিমাণ তিলাওয়াত করে থেমে যাবেন। কিন্তু তিনি তিলাওয়াত চালিয়েই যেতে থাকলেন, আমি মনে মনে বললাম, হয়তো তিনি দু’শত আয়াত পরিমাণ তিলাওয়াত করে রুকুতে যাবেন, কিন্তু তিনি তিলাওয়াত চালিয়েই যেতে থাকলেন। আমি মনে মনে বললাম, হয়তো তিনি পূর্ণ সূরা এক রাকআতেই তিলাওয়াত করে ফেলবেন। কিন্তু তিনি তিলাওয়াত চালিয়ে যেতে থাকলেন এবং সূরা “নিসা” শুরু করে তাও তিলাওয়াত করে ফেললেন। তারপর সূরা “আলে ইমরান” ও শুরু করে তাও তিলাওয়াত করে ফেললেন। তিনি ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করতেন।”
সহীহ। সহীহ আবু দাউদ হাঃ ৮১৫, মুসলিম (ইসলামিক সেন্টার) হা/ ১৬৯১)
যা বুঝা গেলো
সুতরাং যথাসম্ভব ধারাবাহিকতা এবং বড়-ছোটর বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। তবে কখনও এর ব্যতিক্রম হলেও ইনশাআল্লাহ সালাত শুদ্ধ হবে এবং তাতে কোন গুনাহ নেই।
প্রশ্নঃ কুরআন মাজীদে এমন কোন আয়াত আছে, যেখানে সরাসরি নির্দিষ্ট ভাবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে? যদি না বলা হয়ে থাকে তাহলে কিভাবে ও কোন কোন আয়াতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথা বলা হয়েছে?
উত্তরঃ মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিবরণ দিয়েছেন কুরআনে বিভিন্ন স্থানে:
– সন্ধ্যা বলতে এখানে মাগরিব ও ইশার সালাত বুঝানো হয়েছে। – আর সকালে বলতে ফরজ সালাত বুঝানো হয়েছে।
যোহর ও আসরের সালাতঃ
আল্লাহ তাআলা যোহর ওআসরের সালাতের বিষয়ে বলেনঃ
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ “আর দিনের দুই প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশ সালাত প্রতিষ্ঠা করুন”
সূরা হুদ: ১১৪
দিনের দুই প্রান্তের মধ্যে একপ্রান্তে ফজর আর অন্য প্রান্ত যোহর ও আসর নামায উদ্দেশ্য আর রাতের কিছু অংশ সালাত বলতে মাগরিব ও ইশার সালাত উদ্দেশ্য।
ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব ও ইশার সালাতঃ
আল্লাহ তাআলা এ চার সময় সম্পর্কে বলেন:
أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَىٰ غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنَ الْفَجْرِ ۖ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا “সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাত্রির অন্ধকার পর্যন্ত নামায কায়েম করুন এবং ফজরের কুরআন পাঠও। নিশ্চয় ফজরের কোরআন পাঠ মুখোমুখি হয়।”
সূরা ইসরা/ বানি ঈসরাইল: ৭৮
সূর্য ঢলে পড়ার পর হল যোহরের সালাত আর রাত্রির অন্ধকার নেমে আসার পর মাগরিব ও ইশার সালাত। আর ফজর সালাতের কথা তো স্পষ্টই।
পাঁচ ওয়াক্তের আরও বর্ণনাঃ
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:
وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوبِهَا ۖ وَمِنْ آنَاءِ اللَّيْلِ فَسَبِّحْ وَأَطْرَافَ النَّهَارِ “ আপনার পালনকর্তার প্রশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন সূর্যোদয়ের পূর্বে, সূর্যাস্তের পূর্বে এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন রাত্রির কিছু অংশ ও দিবাভাগে
সূরা ত্ব-হা, আয়াত-১৩০
– সূর্যোদয়ের পূর্বে ফজর সালাত – সূর্যাস্তের পূর্বে আসর সালাত। – রাত্রির কিছু অংশ মাগরিব ও ইশার সালাত। – দিবাভাগে যোহর সালাত।
তাফসিরে কিতাব সমূহে এই আয়াতগুলোর ব্যাখ্যায় বর্ণিত সাহাবী ও তাবেঈনদের উক্তিগুলো দ্বারা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয়।
প্রশ্নঃ সেজদায় অনেকেই কুরআনের দোয়া এবং বাংলায় দোয়া পরার ব্যাপারে সম্মতি দেন আবার অনেকে দেন না। কোনটা করা ঠিক হবে?
উত্তরঃ সিজদা ও রুকু অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা জায়েয নয়। তবে কুরআনের দুয়াগুলো দুয়া হিসেবে পড়া যাবে। যেমন হাদীসে আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন,
أَلَا إِنِّي نُهِيتُ أَنْ أَقْرَأَ رَاكِعًا أَوْ سَاجِدًا، فَأَمَّا الرُّكُوعُ فَعَظِّمُوا فِيهِ الرَّبَّ، وَأَمَّا السُّجُودُ فَاجْتَهِدُوا فِي الدُّعَاءِ قَمِنٌ أَنْ يُسْتَجَابَ لَكُمْ “তোমরা শুনে রেখ ! আমাকে নিষেধ করা হয়েছে রুকু অবস্থায় কিরাআত থেকে এবং সিজদা অবস্থায়। রুকুতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা বর্ণনা কর। আর সিজদায় তোমরা দোয়া করতে চেষ্টা কর। তোমাদের জন্য দোয়া কবুল হওয়ার উপযুক্ত সময় এটাই।”
সুনান নাসাঈ হ/১১২০-সহীহ
রুকু-সিজদায় কুরআন তিলওয়াত জায়েজ নাই
উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে জানা যায় যে, রুকু সিজদা অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা জায়েয নাই্। তাই রুকু ও সেজদাহ অবস্থায় অধিক পরিমানে রুকু-সেজদার তাসবীহগুলো পাঠ করতে হবে।
আর সেজদাহ অবস্থায় তাসবীহগুলো পাঠ করার পাশাপাশি হাদীসে বর্ণিত দুয়াগুলো পাঠ করার চেষ্টা করতে হবে। অনুরূপভাবে কুরআনে বর্ণিত দুয়াগুলো দুয়াগুলোও পড়া জায়েয রয়েছে। তবে তা পড়তে হবে দুয়ার নিয়তে; তেলাওয়াতের নিয়তে নয়।
আর সেজদাহ অবস্থায় মাতৃভাষায় দুআর ব্যাপারে কথা হলঃ
প্রথমত, চেষ্টা করতে হবে কুরআন ও হাদীসের দুয়াগুলো পাঠ করার। কেননা এগুলো ব্যাপকার্থ বোধক দুয়া। এ দুয়াগুলোতে মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় কল্যাণ নিহীত রয়েছে। তারপর মহান আল্লাহর নিকট নিজের মত করে মাতৃভাষায় মনের আকুতি তুলে ধরবে। এতে কান আপত্তি নেই।
বিশেষ করে নফল সালাতে্ এ সময় একাকি যথাসম্ভব লম্বা সেজদা দিয়ে নিজের ভাষায় মহান রবের নিকট নিজের সকল চাওয়া-পাওয়া তুলে ধরবে।
সঠিক মতানুসারে এ ক্ষেত্রে ফরজ ও নফলে কোন পার্থক্য নেই। সেজদা অবস্থায় আরবীতে দুআ করা শর্ত করা হলে, অনারব মুসলিমরা আরবী ভাষায় দুআ না করার কারণে বিশাল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে।
প্রশ্নঃ সালাতে সেজদা অবস্থায় অধিক পরিমানে দুআ করার কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। প্রশ্ন হল, এ ক্ষেত্রে আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় দুআ করা জায়েয আছে কি?মাতৃভাষায় দোয়ার পদ্ধতি কি?
উত্তরঃ নামাযে অনারব ভাষায় দুআ করা যাবে কি না এ বিষয়ে আলেমদের মাঝে দ্বিমত আছে। কেউ বলেন, জায়েয নাই। কেউ বলেছেন, জায়েয আছে। কেউ আবার যারা আরবী পারে না কেবল তাদের জন্য জায়েয বলেছেন।
তবে সার্বিক বিচারে সর্বাধিক সঠিক মত হল, আরবি না জানলে নিজ ভাষাতেই দুনিয়া ও আখিরাতের যে কোন কল্যাণের জন্য দুয়া করা জায়েয রয়েছে। সর্ব শেষ মতটিকেই সউদী বড় আলেমগণ সমর্থন করেছেন।
সুতরাং সেজদাহ অবস্থায় অথবা সালাম ফিরানোর পূর্বে দুনিয়া ও আখেরাতের মঙ্গল কামনা করে নিজের পছন্দমত যে কোন দু’আ করবে। পিতা-মাতা ও অন্যান্য মুসলমানের জন্য দু’আ করবে, নিজের বিভিন্ন সমস্যার জন্য দুআ করবে, স্ত্রী-পরিবারের জন্য দুআ করবে…।
মোটকথা, উপরোক্ত ক্ষেত্রে নিজেরমত করে যত খুশি দুআ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে ফরজ অথবা নফল নামযে কোনই পার্থক্য নেই।
আরবীতে দুআ করার শর্ত করা হলে, হাদীসের উদ্দেশ্যই ব্যহত হবে। কারণ পৃথিবীতে সব মানুষের ভাষা আরবী নয়। সুতরাং তাদের দ্বারা আরবীতে দুআ করা আদৌ সম্ভবপর নয়।
উল্লেখ্য যে, সেজাদায় গিয়ে সেজদার তাসবীহগুলো আরবীতে পাঠ করার পর সর্ব প্রথম চেষ্টা করবে, হাদীস বা কুরআনে বর্ণিত আরবী ভাষায় দুআগুলো যথাসম্ভব পাঠ করার। তারপর নিজের সমস্যা ও চাওয়া-পাওয়া মহান রবের দরবারে নিজের ভাষায় কাকুতি-মিনতি সহ কান্না বিজড়িত কণ্ঠে তুলে ধরে দুআ করবে। আল্লাহু আলাম।
We use cookies on our website to give you the most relevant experience by remembering your preferences and repeat visits. By clicking “Accept All”, you consent to the use of ALL the cookies. However, you may visit "Cookie Settings" to provide a controlled consent.
This website uses cookies to improve your experience while you navigate through the website. Out of these, the cookies that are categorized as necessary are stored on your browser as they are essential for the working of basic functionalities of the website. We also use third-party cookies that help us analyze and understand how you use this website. These cookies will be stored in your browser only with your consent. You also have the option to opt-out of these cookies. But opting out of some of these cookies may affect your browsing experience.
Necessary cookies are absolutely essential for the website to function properly. These cookies ensure basic functionalities and security features of the website, anonymously.
Cookie
Duration
Description
cookielawinfo-checkbox-analytics
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Analytics".
cookielawinfo-checkbox-functional
11 months
The cookie is set by GDPR cookie consent to record the user consent for the cookies in the category "Functional".
cookielawinfo-checkbox-necessary
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookies is used to store the user consent for the cookies in the category "Necessary".
cookielawinfo-checkbox-others
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Other.
cookielawinfo-checkbox-performance
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Performance".
viewed_cookie_policy
11 months
The cookie is set by the GDPR Cookie Consent plugin and is used to store whether or not user has consented to the use of cookies. It does not store any personal data.
Functional cookies help to perform certain functionalities like sharing the content of the website on social media platforms, collect feedbacks, and other third-party features.
Performance cookies are used to understand and analyze the key performance indexes of the website which helps in delivering a better user experience for the visitors.
Analytical cookies are used to understand how visitors interact with the website. These cookies help provide information on metrics the number of visitors, bounce rate, traffic source, etc.
Advertisement cookies are used to provide visitors with relevant ads and marketing campaigns. These cookies track visitors across websites and collect information to provide customized ads.